মেয়েটা বসার পরপরই মুখ থেকে নেকাপটা সরালো ৷ তার চেহারাটা আমার চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল ৷ অন্ধকারে তার মুখ ভালভাবে দেখা যাচ্ছেনা কিন্তু যখন থিয়েটারের পর্দার প্রতিফলিত শক্তিশালী আলো তার চেহারাতে পড়লো তখন তার চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম ৷ তাকে দেখা মাত্র হকচকিয়ে উঠলাম ৷ ভ্যাঁবাচেকা হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দু-চোখ বরাবর ৷ অবাকের যেন চূড়ায় পৌঁছে গেছি আমি ৷ এটা আমি কস্মিনকালেও কল্পনা করিনি ৷ আমার হ্নদয়ে ভালবাসার প্রদিপ জ্বালিয়ে দিয়েছিল যেই মেয়েটি, যে আমাকে প্রেম নামক শব্দের সাথে পরিচয় করাতে বাধ্য করেছিল ৷ ভালবাসি কথাটির অর্থ বুঝতে ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল ৷ যার মোহে ডুব দিয়ে ভালবাসার ঝিনুক কুঁড়িয়ে মুক্তা সংগ্রহ করেছিলাম সেই মানুষটি আজ আচমকা আমার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে ৷ হ্যাঁ, জঙ্গলে দেখা সেই মেয়েটি যার নাম দিয়েছিলাম রাহনুমা সে এখন আমার পাশে বসা ৷ ভাবতে লাগলাম তাকে নিয়ে ৷ এখানে কেমনে এলো সে? মুভি দেখতেই কি ঢাকায় এসেছে? না এটা তো অযৌক্তিক হয়ে যায়, নিশ্চয় ঢাকায় তার আত্মীয়স্বজন বসবাস করে; তাদের কাছেই এসেছে ৷ হয়তো সময় কাটছিলনা তাই মুভি দেখতে চলে এসছে ৷ কৌতূহল জেগে বসলো আমার মনে তার এখানে আসার হেতু জানার জন্য ৷ ভাবনায় আরো গভীরভাবে ডুবে গেলাম ৷ ভাবনাগুলো কেবল রাহনুমাকে নিয়ে তৈরি হওয়া প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিল ৷ রাহনুমা মুভি দেখায় এমনভাবে মন দিয়েছে আমি যে ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছি সেটাতে তার খেয়াল নেই ৷ আমার প্রতি তার ভ্রুক্ষেপ না থাকলেও সমস্যা নেই ৷ সে যে আমার পাশে আছে এই অনেক ৷ সত্যি বলতে কি খুবই ভাললাগছে তাকে পাশে পেয়ে ৷ না চাইতেই তার সাথে দেখা হয়ে যাবে এটা ভাবনাতেও ছিলনা ৷ মনে প্রশান্তির ঝড় শুরু হয়েছে তাকে দেখার পর থেকে ৷ তবে চিন্তায় পড়ে গেলাম অনুর জন্য ৷ সে ওয়াশরুম থেকে এখানে এলে পাশে এই মেয়েটাকে দেখে রাগে বাঘিনী হয়ে যাবে ৷ তখন পড়তে হবে বিপাকে ৷ রাহনুমা নেকাপটা খুলেই পপকর্ণ খাওয়া শুরু করেছিল এবং মুভি দেখায় মন দিয়েছিল ৷ তাড়াতাড়ি করে পপকর্ণ খাওয়ায় পপকর্ণ শেষ হয়ে গেল ৷ পপকর্ণের নেশায় পড়ে গেছে হয়তো ৷ আবারো হয়তো পপকর্ণ কিনে আনবে ৷ এজন্য সে সিট থেকে উঠলো ৷ আমাকে কিছু না বলেই চলে গেল ৷ এবারো ভুল করলাম ৷ কেন যে পাশে থাকাকালিন তাকে কিছু বলতে পারিনা! সাহস শক্তি দুটোই যেন কোন জগতে হারিয়ে যায় ৷ বলবো বলবো করে তাকে কিছু বলা হয়না ৷ পপকর্ণ নিয়ে যদি আবারো ফিরে আসে তাহলে যেভাবে হোক সাহস করে তার সাথে কথা বলতেই হবে ৷ ধুরুধুরু বুকটাকে শান্ত বানিয়ে তাকে আমার মনের যাবতীয় কথাগুলো বলে দিবো ৷ মুভির পর্দাতে আর নজর যাচ্ছেনা ৷ রাহনুমা আসবে কিনা এই চিন্তায় বিভোর আমি ৷ ওদিকে অনেকক্ষণ হয়ে গেল অনু আসছেনা ৷ ওয়াশরুমে এতক্ষণ কি করে সে? মনে মনে কথাটি বলতে না বলতেই অনু চলে আসলো ৷ হাতে পানির বোতল, এবং পপকর্ণ ৷ বোরখার রং দেখেই বুঝা যায় ওটা অনু ৷ তার মুখ দেখার প্রয়োজন নেই ৷ সে নিজ থেকে মুখ না দেখালে আমার হাজারো আবদারেও মুখ দেখাবেনা ৷ রাহনুমার জন্য মনটা ছটফট করছিল ৷ সে যদি আসতো তাহলে অনুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতাম ৷ তবে অনু বিষয়টা কেমনে নিতো সেটার প্রশ্ন থেকেই যায় ৷ না রাহনুমা এলোনা ৷ মনটা বিষাদে ভরে গেল ৷ সিনেপ্লেক্সের ভেতর আর থাকতে মন চাচ্ছিল না ৷ অনুকে অনুরোধ করে বললাম বাড়ি চলে যাবো ৷ সেও বললো চলেন ৷ আমার আগেই অনু সিনেপ্লেক্স থেকে বের হলো ৷ আমি যখন বের হলাম বাইরে গিয়ে দেখি অনু নেই ৷ আঁতকে উঠলাম তাকে না পেয়ে ৷ আশপাশটা খুব ভালভাবে দেখলাম কিন্তু অনুর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না ৷ আশ্চর্য, মানুষটা গেল কই? ফাইজলামী করছে নাকি আমার সাথে? মুহূর্তের মধ্যে একটা মানুষ গায়েব হয়ে যায় কেমনে? তাকে না পেয়ে কষ্টও লাগছিল আবার রাগও হচ্ছিল ৷ বিষন্ন মনে আমার গাড়ির নিকট গিয়ে দাঁড়ালাম ৷ গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে তাকাতেই দেখি অনু বসে আছে ৷ গাউন পড়ে আছে সে ৷ হলিউড অ্যাক্ট্রেসদের মত লাগছে ৷ এখন ঠিকই সে মুখটা খোলা রেখেছে ৷ অথচ যদি বাসায় সবার সামনে তাকে বলি মুখটা দেখাও তখন ভাব দেখাবে ৷ নিজেকে শালিন মেয়ে প্রমাণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে ৷ এসব করে সে কি মজা পায় বুঝিনা কিছু! অনু দুষ্টুমীমাখা অভিব্যক্তিতে আমাকে ইশারা করছে যেন তার কাছে যাই!
এখনই সুযোগ অনু যে আবেদনময়ী এর প্রমাণ সংরক্ষণ করার ৷ যাতে পরবর্তিতে তাকে প্রমাণ দেখাতে পারি ৷ আমার ফোনটা বের করে ক্যামেরাতে কয়টা ছবি তুললাম, সেগুলো সেভ করলাম ৷ এমনকি ২০ সেকেন্ডের একটা ভিডিও করলাম ৷ এবার আর অনু আমার সাথে চালাকি করতে পারবেনা ৷ ছবি তোলা শেষ করে গাড়িতে প্রবেশ করলাম ৷ ড্রাইভিং সিটে আমি, আর পাশে অনু বসা ৷ গাড়ি চলছিল ৷ অনু আমার বাম হাতটা শক্ত করে ধরে আছে ৷ কিছু বললাম না ৷ প্রশ্রয় দিতে ভাললাগে ৷ সব সময়ের জন্য তার দৃষ্টি আমার চেহারা বরাবর রইলো ৷ যে কয়বার তার দিকে তাকালাম প্রতিবারই দেখতে পেলাম তার চোখে, মুখে অদ্ভুত রকমের হাসি ৷ তার মুখের অভিব্যক্তিতে লক্ষ্য করলাম কি যেন বলতে চায় আমাকে ৷ কিন্তু সাহস করে বলতে পারছেনা ৷ হয়তো আমার মত অবস্থা হয়েছে তার ৷ রাহনুমাকে ভালবেসে ফেলেছি অথচ বারবার সে আমার কাছে আসা সত্বেও তাকে কিছু বলতে পারছিনা ৷ সারা রাস্তাতে অনু মাত্র ২টা কথা বললো ৷ প্রথম কথাটি ছিল, “নীল, যদি আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায় তাহলে কি আমাকে মেনে নিতে পারবেন?"
দ্বিতীয় কথাটি ছিল, “আমার স্বপ্ন বাসর রাতে অন্তত ১ মিনিট আপনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সুখ নেওয়া!"
.
অনুর কথার কোনো প্রতিত্তর না দিয়ে শুধু মিষ্টি করে হেসেছিলাম ৷ আমার ভাবতে অবাক লাগে অনুর মত এত সুন্দরী মেয়ে আমার মত একজন কালো ও অসুন্দর মানুষকে ভালবাসলো? এটা আসলেই অবিশ্বাস্য ব্যপার ৷ বিশ্বাসযোগ্য হোক বা না হোক, আমাকে ভালবাসার অপরাধে তাকে যে কাঁদতে হবে এটা সবসময়ের জন্য চিরন্তন সত্য!
.
গাড়ি চলছিলো ৷ হঠাৎ আমাদের বাসার অনেকটা পথ আগেই গাড়িটা থামিয়ে দিলাম অনুর যন্ত্রণায় ৷ সে জোরাজুরি করছিল যেন আমি গাড়ি থামাই ৷ গাড়ি থামানো হলে অনু আমাকে ঝাঁপটে ধরলো ৷ মনে হলো আমি নিরিহ হরিণ আর সে হিংস্র বাঘিনী ৷ আমাকে খুবলে খেতে শরীরের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ৷ আমার উড়ুর উপর বসে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে কোনোরকম কথাবার্তা না বলে ঘারে, কপালে চুমু দিয়ে যাচ্ছিল ৷ অনু যেন পাগল হয়ে গেছে ৷ তাকে থামানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল ৷ আমিও যেন অপারগ ৷ তাকে থামানোর ইচ্ছা বিলিন হয়ে গেছে ৷ হয়তো আমার মনবৃত্তি চাচ্ছেনা অনুর থেকে রেহায় পেতে ৷ অনুর শরীরের পরশ নিতে অবুঝ মন যেন উত্তপ্ত কড়ায়ের পানির মত হয়ে গেছে, তাকে থামাতে গেলেই যেন নিজের ক্ষতি!
চোখ বন্ধ করে রেখেছি ৷ থরথর করে কাঁপতে থাকা পুরো শরীর ও ধুকধুক করতে থাকা বুক যেন অনুর হয়ে গেছে ৷ সে যেভাবে পারছে আমাকে নিয়ে খেলায় মেতে আছে ৷ হঠাৎ করে সে আমার কপালে আলতো ভাবে চুমু বসিয়ে দিয়ে শরীর থেকে নেমো গেলো ৷ অনু আমার শরীর ছেড়ে দেওয়ায় দম নিলাম লম্বা ভাবে ৷ অতঃপর নিজেকে শান্ত করে তাকে নিচু গলাতেই বললাম,
----এই যে নির্লজ্জতা দেখালে, এটা তুমি হয়তো বাড়িতে পৌঁছেই অস্বীকার করবে ৷ তুমি যে কি এটাই আমি বুঝতে পারিনা ৷ আচ্ছা অনু, তোমার সাথে কি জ্বীন টিন ভর করে নাকি? দু-রকম ব্যবহার কেমনে করো? একই মানুষের দ্বৈত রুপ আসলেই রহস্যজনক ব্যাপার ৷ আমি না বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি তোমার আচরণে!
.
অনু আমার কথার জবাবে একটা কথাও বললোনা ৷ যেন মনে হলো সে কিছু শুনতেই পায়নি ৷ অনুর মুখ থেকে আমার কথার কোনো জবাব না পেয়ে তার প্রতি বিব্রত হলাম সেইসাথে রাগান্বিত হলাম ৷ তীব্র বিতৃষ্ণা ও বিরক্ত ভাব নিয়ে আবারো গাড়ি চালাতে লাগলাম!
.
গাড়ি বাসার সামনে এসে থামানো হলে অনুর আগে আমিই গাড়ি থেকে বের হলাম ৷ আমার রুমে প্রবেশ করার পর ফোনের কথা মনে পড়ে গেল ৷ পকেটে ফোন পেলাম না ৷ নিশ্চয় গাড়িতে রেখে আসছি ৷ ফোনটা নিতে আবারো গাড়ির নিকট যেতে হলো ৷ আমার সিটের পাশে রাখা ছিল, ওখানেই আছে; ওখান থেকেই ফোনটা নিলাম ৷ সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে ৷ শীত অনেকটা কম আজ ৷ কুয়াশা নেই ৷ এজন্য বাইরে কাটিয়ে এসে দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি ৷ তবে খুব ক্লান্ত আমি ৷ কোনোমত ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম!
হঠাৎ, আমার ফোনটা বেজে উঠলো ৷ ফোনের স্কিনে চোখ পড়তে দেখলাম অনু কল দিয়েছে ৷ আরে আশ্চর্য একই বাড়িতে দুজন অথচ সে কল দিচ্ছে! আমার রুমে এলেই তো কথা বলতে পারে ৷ নাকি তার সেই রোগ শুরু হয়ে গেছে ৷ আমার সামনে মুখ দেখায়না, এখন নিশ্চয় সামনাসামনিও হবেনা? খিলখিলিয়ে হাসতে মনে চাইলো ৷ হাসতে হাসতে ফোনটা রিসিভ করলাম ৷ রিসিভ করতেই অনু জোরালো কন্ঠে বলল,
----আপনি কি মানুষ? সিনেপ্লেক্সে একা একটা মেয়েকে রেখে যে চলে গেলেন, এটা কি ঠিক কাজ করেছেন?
.
অনুর কথা শুনে আকাশ থেকে ধপাস করে পড়লাম ৷ মনে হলো দেহে প্রাণ নেই ৷ প্রাণ ছাড়ায় বেঁচে আছি ৷ বুকটা ছ্যাৎ করে উঠেছে তার কথার দাপটে ৷ কি আশ্চর্য রকমের কথা শুনালো আমাকে ৷ মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে নিশ্চয় ৷ মাতই্র আমার সাথে বাসায় এলো, আর এখন বলছে আমি নাকি তাকে সিনেপ্লেক্সে রেখে আসছি ৷ বিছানা থেকে উঠে অনুর রুমে গেলাম, পেলাম না ৷ ড্রয়িংরুম, ওয়াশরুম, ছাদ সবখানে খুঁজলাম তার কোনো হদিস নেই ৷ ফোনে অনবরত অনু কথা বলে যাচ্ছে আর আমি নির্বাক দর্শক হয়ে তার কথা গিলে যাচ্ছি ৷ কান যেন ঝালাফালা হয়ে গেল তার জোরালো কন্ঠের কথা শুনে ৷ বাসায় যখন অনুকে কোথাও পেলাম নাা, তখন নিজেকে যেন সদ্য পাবনা পাগরা গারদ থেকে ফেরা মহাপাগল বলে মনে হলো ৷ অনুকে পাগল বলতাম এখন তো দেখছি নিজেই একটা পাগল ৷ গাড়িতেে নিশ্চয় অনু ছিলনা ৷ কিংবা কেউ ছিলই না, হয়তো ভ্রমে তাকে দেখতে পেয়েছিলাম ৷ অথবা গাড়িতে যে ছিল সে আসলে অনুই না অন্য কেউ ৷ আমি তো কখনো লোকজনের সামনে থেকে অনুর মুখ দেখতে পারিনি ৷ হয়তো অনুকে দেখিই নি কখনো ৷ যাকে দেখেছি সে আসলে অনু নয় অন্য কেউ ৷ আজকে প্রমাণ হবে আমি যাকে অনু হিসেবে চিনি সেই অনু নাকি নেকাপ দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা মেয়েটিই অনু ৷ তাড়াতাড়ি করে আমার গাড়িটা নিয়ে চললাম সিনেপ্লেক্সের দিকে ৷ সেখানে পৌঁছেই দেখি অনু সিনেপ্লেক্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ৷ হতভম্বের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম ৷ এবার আর অবিশ্বাস করার উপায় নাই যে আমি ঐ আবেদনময়ী অনুকেই কল্পনা করতাম ৷ আমার ভিন্নরকম জগতে ঐ অনুর বসবাস ৷ যাকে আমি নানাভাবে কল্পনা করি ৷ এটা হয়তো অন্যরকম মোহ, বিভ্রান্তিকর ভ্রম ৷ কিন্তু আমি কেন তাকে নিয়ে এমন কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করছি? তাকে তো আমি ভালবাসিনা! তাহলে কেন এমন বোকামী আমার?
অনুর দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম সে রাগে গজগজ করছিল ৷ হাত পা স্থির ছিলনা তার ৷ তার ভাবভঙ্গিমা দেখে ভয় লাগছিল ৷ কাছাকাছি হবার সাহস হচ্ছিলনা ৷ আমাকে দেখে অনু নিজেই এগিয়ে আসলো ৷ ভাবছি রাগে থাপ্পর বসিয়ে দেয় কিনা? কিন্তু না, অনু আমার হাতটা ধরে নরম গলায় বলল,
----চলুন, এরকমটা যেন দ্বিতীয়বার না হয়!
.
গাড়িতে চড়ার পর বারবার মাথায় অনুর সাথে ঘটে যাওয়া রোমান্সকর মুহূর্তের কথা মনে পড়ছিল ৷ গাড়িতে সেসময় সে আমার সাথে এতটাই রোমান্সকর ঘটনা ঘটিয়েছিল যে সেগুলো যেন স্মৃতিফলক হয়ে এই মস্তিস্কে ঢুকে আছে ৷ অথচ এটাকে এখন অবাস্তব ও ভ্রম হিসেবে মানতে হচ্ছে ৷ কিন্তু এখনো আমার শার্টে অনুর লিপিস্টিকের দাগ দেখতে পাচ্ছি ৷ এটা কিভাবে অস্বীকার করতে পারি আমি? অনুকে ব্যাপারটা বললে সে কিছুতেই এটা বিশ্বাস করবেনা ৷ এরপরও তাকে সাহস করে বললাম,
----অনুু একটা ঘটনা ঘটে গেছে!
অনু তীক্ষ্ণকন্ঠে বলল,
---কি ঘটনা?
---্আমি তখন তোমাকে নিয়েই বাসায় ফিরেছিলাম ৷ তোমার পড়নে গাউন ছিল ৷ এমনকি তুমি আমাকে কপালে চুমুও দিয়েছিল ৷ অথচ, তুমি বলছো আমার সাথে তখন বাসায় যাওই নি ৷
----আচ্ছা, আপনি কি সত্যিই সুস্থ্য মস্তিষ্কের মানুষ? বুঝিনা আমাকে নিয়ে এতসব চিন্তা আপনার মাথায় কেমনে আসে? দিনে দিনে আপনি আমার নিকট একজন বিরক্তির মানুষ হয়ে উঠছেন!
----এক মিনিটের জন্য নিজেকে পাগল হিসেবে মেনে নিলাম ৷ কিন্তু যদি প্রমাণ করতে পারি যে তুমি তখন আমার গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলে এমনকি আমার সাথে রোমান্সকর মুহূর্ত পার করেছিলে!
তখন কি বলবে? অস্বীকার করবে না তো?
----ওকে, দেখান আপনার প্রমাণ!
.
ঐসময় ফোনে অনুর গায়ে যেরকম গাউন পড়া ড্রেস ছিল, সে অবস্থায় তার কয়েকটা ফটো তুলেছিলাম এবং একটা ভিডিও করেছিলাম ৷ সেটা মোবাইলে সেভ করা আছে ৷ অনুকে দেখালে সেটা আর অবিশ্বাস করতে পারবেনা ৷ ভিডিওটার কথা মনে পড়ায় নিজের কনফিউশনটা কেটে গেছে ৷ এখন নিজেকে সুস্থ্য মানসিক সম্পন্ন লোকই মনে হচ্ছে ৷ আবেদনময়ী অনু আসলে আমার ভ্রম নয় বরং বাস্তব!
ফোন থেকে প্রথম ভিডিওটা বের করে অনুর নিকট ফোনটা দিলাম ৷ অনু মন দিয়ে ভিডিওটা দেখছিল আর মুচকি মুচকি হাসছিল ৷ তার হাসার কারণ বুঝতে পারলাম না ৷ কপালে চিন্তার ছাঁপ ফেলে অনুকে কৌতূহলচিত্তে বললাম,
----কি ব্যাপার হাসছো কেন?
অনু ফিক করে হেসে বলল,
----কি ভিডিও দিলেন এটা? ফাঁকা গাড়ির ভিডিও দেখে কি করবো? আপনি কি বোকা? কিসের জন্য ফাঁকা গাড়ি ও সিট ভিডিও করে রেখেছেন? ওহ বুঝছি বিক্রয় ডট কমে গাড়ি বিক্রির জন্য ভিডিওটা আপলোড দিবেন, তাইতো?
.
অনুর কথায় হতবাক আমি ৷ ঢোক গিলে ফোনটা তার হাত থেকে নিয়ে ভিডিওটা দেখলাম ৷ আসলেই তো ফাঁকা গাড়ি ৷ অনু ঠিকই বলেছে ৷ আমি তাহলে ভ্রমের জগতেই আছি ৷ ফটোগুলো দেখতে হবে ৷ ফটোগুলো অপেন করে দেখি ফাঁকা গাড়ি এবং ফাঁকা সিটের ছবিগুলো ভেসে উঠছে! মুখটা এতটুকু হয়ে গেল আমার ৷ কালই সাইক্লিয়ার্টিস্টের সাথে দেখা করতে হবে ৷ নিশ্চয় পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি ৷ এভাবে চলতে থাকলে পাগলা গারদই শেষ ঠিকানা হবে আমার!
.
অনু আমার বিষন্ন চেহারা দেখে মৃদ্যু স্বরে বলল,
----মন খারাপের কি আছে? আমাকে নিয়ে যত খুশি পারেন কল্পনা করুন, নিষেধ করবোনা ৷ তবে শর্ত একটা!
তোরজোর কন্ঠে বললাম,
----কি শর্ত?
----আপনি ভুলেও অন্য কারো হবার চেষ্টা করবেন না!
----তো কার হবো?
----কারো না ৷ সারাজীবন একা থাকবেন ৷ যেমনটা আমি থাকবো!
----এখন তো আমাকে না, তোমাকেই পাগল মনে হচ্ছে"
----আমি পাগল না, আমি একজন পাগলী ৷ সেটা আপনার জন্য ৷ এবার চুপচাপ গাড়ি চালান ৷ আর হ্যাঁ, আজকে রাতে আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে!
----কি সেটা?
----সেটা রাত হলে জানবেন!
.
রাতে রান্না অনুই করলো ৷ বিরিয়ানি রান্না করেছে সে ৷ দুজনে একসাথে খাওয়া শুরু করলাম ৷ অনু আর আমি মুখোমুখি বসে খাচ্ছি ৷ তার চোখ আমার চোখে আর আমার চোখ তার নেকাপ বরাবর ৷ কষ্ট করে খাবে অথচ মুখটা দেখাবেনা ৷ খাওয়া শেষ করে আমি আমার রুমে গেলাম ৷ বই পড়ছিলাম ৷ আচমকা অনু রুমের ভেতর প্রবেশ করলো ৷ বোরখা গায়ে দেওয়া কিন্তু নেকাপ মুখে নেই ৷ ওড়না পেঁচিয়েছে মুখে ৷ অনুর হাতে একগুচ্ছ গোলাপ!
তার লক্ষ্যণ ভাল দেখছিনা ৷ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি তার দিকে ৷ অকস্মাৎ অনু আমার হাতে ফুলগুলো ধরিয়ে দেবার পর আদুরে গলায় বলল,
----আমাকে বিয়ে করবেন? একটা কথায় উত্তর দিবেন ৷ হ্যাঁ, অথবা না!
.
যা ভেবেছিলাম তাই হলো ৷ সে যে প্রেমের প্রস্তাব দিবেনা ভাল করে জানতাম ৷ অবাক হলাম না ৷ খুশি বা রাগান্বিতও হলাম না তার আচরণে ৷ তাকে উত্তর দেবার জন্য ভাবতে হলোনা ৷ সহজ গলায় উত্তর দিলাম,
----না ৷ আমি তোমাকে বিয়ে করবোনা ৷ এক কথাতেই বললাম!
.
অনু বিয়ের প্রস্তাব দেবার পর লাজরঙ্গা হয়ে মাথা নিচু করে ছিল ৷ কিন্তু তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করাই তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল ৷ তার অশ্রুভেজা চোখে যেন দুঃখের অনলের ছাঁপ খুঁজে পেলাম!
অনু একরাশ দুঃখ নিয়ে ধীর পায়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল ৷ তার কষ্ট দেখে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া হলোনা! জানতাম তাকে আমার জন্য কাঁদতে হবে ৷ শুধু শুধু আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল!
.
.
ওয়াশরুম থেকো টাওয়াল জড়িয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে রুমের ভেতরে ঢুকলো অনু ৷ ভেজা চুলে তাকে দেখে চোখ সরাতে পারছিনা ৷ শুধু বিমোহিত নয়নে তাকিয়ে থাকতে মন চাচ্ছে ৷ পাগল মনটা অনুর ঢেউ খেলানো দেহের রুপে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল ৷ এলোমেলো ভাবনাগুলো মাথায় এসে ঘুরপাক খাচ্ছিল ৷ আচমকা অনু তার গা থেকে টাওয়াল সরিয়ে আমার গায়ের উপর ছুঁড়ে মারলো ৷ অতঃপর অন্য রুম থেকে একগুচ্ছ গোলাপফুল এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
----কি চাস? আমার শরীর? নাকি আমার ভালবাসা?
.
তাকে প্রতিত্তরে কিছুই বলতে পারছিনা ৷ কথা বের হচ্ছেনা গলা দিয়ে ৷ মুখের ভেতর কাঁটা দিয়ে আটকে রেখেছে কে যেন?
অনুর কথার কোনো জবাব দিতে পারছিনা দেখে সে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে অগ্নিমূর্তি রুপ ধারণ করলো ৷ ড্রয়ার থেকে রিভলবার বের করলো ৷ ৷ রিভলবার দেখে আঁতকে উঠলাম ভয়ে ৷ আমার আত্মা যেন শুকে কাঠ হয়ে গেল ৷ ভয়ে প্রাণ একবার দেহ ছাড়ছিল আরেকবার দেহ ছুঁয়ে দিচ্ছিল!
অপ্রত্যাশিতভাবে, অনু রিভলবারের ট্রিগারে চাপ দিলো ৷ বিকট শব্দ হলো ৷ বুলেট বিদ্ধ হলো আমার বুকের বা-পাশে ৷ তরতর করে রক্ত পড়ছে ৷ অথচ আমার ব্যাথা হচ্ছিল না ৷ শুধু হাত-দু'খানা শীতল হয়ে এলো!
আপনাআপনিই ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার ৷ এতক্ষণ ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম ৷ ঘর্মাক্ত ও ঘুম জরানো চোখে দেখতে পেলাম অনু আমার হাত ধরে আছে ৷ সামান্য শব্দ তৈরি করে কাঁদছে সে ৷ তার চোখ দিয়ে অনবরত চোখের জল ঝরছিল দেখে জোরালো কন্ঠে বললাম,
----কি ব্যাপার, কাঁদছো কেন এভাবে?
.
অনুর কান্নার শব্দ যেন বেড়ে গেল ৷ এবার হাউমাউ করে কাঁদছে ৷ অসহ্য লাগছে কান্না দেখে ৷ ধমক মেরে বললাম চুপ করো ৷ অনু ধমক শুনে কেঁপে উঠলো ৷ কান্নার শব্দ কিছুটা কমে আবারো উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলো!
আবারো ধমক মারলে, অনু উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
----আমাকে ভালবাসতে কি সমস্যা আপনার? আমার কিসের অভাব? রুপে,যৌবনে কিসের সমস্যা? সেই ক্লাস ৮ থেকে আপনার পিছু নিয়েছি ৷ কখনোই আমাকে বুঝলেন না ৷ যখন আপনি এসএসসি পরীক্ষা দিলেন, আর আমি ক্লাস ৮ এ তখন আপনাকে আমি একটা চিঠি দিয়েছিলাম ৷ চিঠিটা পেয়ে আপনি যেন হিরো হয়ে গেছিলেন ৷ আমার প্রস্তাব প্রত্যাখান তো করলেন, সেই সাথে মজা করলেন চিঠিটা নিয়ে ৷ পুরো স্কুল, পাড়া প্রতিবেশীর সবাইকে চিঠিটার কথা বলে দিয়েছিলেন ৷ খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন ৷ ঐদিন পর থেকে সবার হাসির পাত্র হয়েছিলাম ৷ এরপরও আপনার প্রতি আমার ভালবাসা একটুও কমেনি ৷ আপনি গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেলেন যেদিন, সেদিন থেকে প্রতিটা দিন আমি সীমাহীন কষ্টে কাটিয়েছি ৷ আমি এসএসসিতে পাশ করার পর থেকে আপনার ঠিকানায় কমপক্ষে ১হাজার টা চিঠি দিয়েছিলাম ৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য আপনি একটা চিঠিরও উত্তর দেননি ৷ আমার তো মনে হয় আপনি চিঠিগুলো খুলেই দেখেন নি!
এত ভালবাসি আপনাকে অথচ আমাকে এড়িয়ে চলেন ৷ আমি স্কুল লাইফে দেখতাম আপনি পর্দায় থাকা মেয়েদের পছন্দ করেন ৷ এজন্য সিদ্ধান্ত নিই আমি পর্দানশীল হয়ে যাবো, তাছাড়া ইসলাম ধর্মের প্রতিও আমার একটা টান ছিল তাই পর্দাকে ধারণ করি ৷ কিন্তু এতেও আপনি আমার প্রতি আকৃষ্ট হলেন না ৷ কিন্তু কেন? আজকে আবারো লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম, এরপরও ফিরিয়ে দিলেন, কেন? কিসের জন্য? আমার দোষটা কোথায়? নাকি ভাবী বানিয়ে বানিয়ে এসিড নিক্ষেপের গল্প বলেছিল সেটার জন্য ভেবে নিয়েছেন আমাকে দেখতে কুৎসিত লাগবে তাই আমার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন না, তাইতো? কিন্তু না, আমাকে কেউ এসিড নিক্ষেপ করেনি ৷ ঐসবই ভাবীর বানানো কথা ছিল ৷ জানেন কিসের জন্য আমি লেখাপড়ায় এত পিছিয়ে? এজন্যই যাতে তাড়াতাড়ি লেখাপড়া শেষ না হয় ৷ লেখাপড়া শেষ হলেই বাবা, মা অন্যকারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে ৷ আর আমি তো চাইনা আপনাকে ছাড়া বিয়ে করতে ৷ আপনি যে অনেক দেরিতে বিয়ে করবেন এটা ভাল করে জানতাম ৷ এজন্য এসএসসিতে ২বার অকৃতকার্য হবার পর ৩ বারের বার পাশ করেছিলাম ৷ কেন অকৃতকার্য হয়েছিলাম জানেন? কারণ প্রতিবারই ফাঁকা খাতা জমা দিতাম ৷ ইন্টারেও ২বার অকৃতকার্য হয়েছিলাম ৷ সবই ছিল আপনাকে ভালবাসার কারণে ৷ এসব কিছুই আপনাকে চিঠির ভাষায় লিখে পাঠিয়েছিলাম,অথচ আপনি চিঠির জবাব দেন নি ৷ কিসের জন্য বলেন তো?
.
অনু কথাগুলো অনেক কষ্টে, ক্রন্দণরত অবস্থায় ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছিল ৷ তার কথায় কষ্টের উদয় হলেও নিজেকে এসবের জন্য দোষী বলে মনে হলোনা ৷ আমি তো তাকে বলিনি এরকম নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসো ৷ ভীষণভাবে অবাক হলাম চিঠির কথা শুনে ৷ সে এতগুলো চিঠি লিখেছিল অথচ, আমি এর কিছুই জানিনা ৷ তীর্যক কন্ঠে বললাম,
----কই আমি তো কোনো চিঠি পাইনি!
.
অনু চোখের পানি মুছতে গিয়ে থেম গেল ৷ অতঃপর জোরালো কন্ঠে বলল,
----মিথ্যাচার করবেন ভাল করে জানতাম ৷ আমি জানি আপনি এখন আর কিছুতেই আমাকে ভালবাসবেন না ৷ আমার কষ্টে বিন্দুমাত্র ব্যথিতও হবেন না ৷ কারণ আপনি অন্যকারো জন্য দিওয়ানা ৷ কিন্তু সে কি আমার চেয়ে পারফেক্ট ছিল? দেখুন তো!
.
কথাটি বলেই অনু তার মুখ থেকে ওড়নাটা সরিয়ে ফেলল.....
No comments