হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤ ----পর্ব_৬
মাথাটা এলিয়ে দিলো মাইশা টেবিলের মধ্যে। আয়াতের ওই নেশামাখানো কথাগুলো কোনোক্রমেই স্মৃতিতে আনতে চাচ্ছে না। বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
--''শেষে ওই কথাটা না বললে পারতেন না? তবে আমার এমন পাগল পাগল লাগতো না।''
হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনে ধ্যান ভাঙলো মাইশার। আনানের নাম্বার স্ক্রীনে ভেসে উঠছে। মাইশার কপাল কুচকে এলো । আনানরে এখন পেলে ইচ্ছেমতো চড়-থাপ্পড় মারলেই যেন ওর অশান্ত মন শান্ত হতো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
--''হারামজাদাটা একটু কল্পনাও করতে দিবো না।''
প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করলো মাইয়্যা। ওপাশ থেকে আনান বললো,
--''কিরে মাইয়্যা?মোবাইলের শ্রাদ্ধ হইছে নাকি? দুইদিন ধরে কল দিতাসি হারামি ফোন ধরলে কি তোর জামাই মরতো?''
--''এ্যাহ্ ! আমি আসুম আর তোর বদমাইশ ভাই আমারে কিছু কইবো না এটা কি সম্ভব?হালায় রাগতো নাকের ডগায় নিয়া ঘুরে। আমার তো দেখলেই কাপাঁপাকিঁ শুরু হইয়া যায়।''
অন্য সময় নিজের ভাইয়ের বদনাম শুনে মাইশা আনানে ঝাড়ি মেরে নিঃশেষ করে ফেলতো কিন্ত এখন এসব কিছুর মনমেজাজে মাইশা নেই। দুর্বল কন্ঠে তাই বললো,
--''ফোন করেছিস কেন এটা বল্?''
--''কাল ক্যাম্পাসে আসিস। তোরে ছাড়া ভাল্লাগেনা রে। অর্পির প্যান প্যান , সামাদ পৃথার বাবু-বাবু ডাক এগুলা শুইন্না মাথাটা ম্যাজম্যাজ করতাসে।''
--''ওহ্''
--''তোর হইসে টা কি? কোন পোলার শোকে এমন দেবদাসী হয়ে বসে আছিস?''
মাইশা শুকনো ঢোক গিলে। আয়াতের নাম যে সারাক্ষণ মাথায় ঘুরঘুর করছে এটা কিছুতেই আনানকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। আমতা আমতা করে বললো,
--''ইয়ে................মানে, আমি আবার কোন ছেলের কথা ভাববো? পাগল তুই?''
--''আসলেই আমার মাথাটা মনে হয় গেসে। তুই? আবার একটা ছেলেরে নিয়া ভাববি? সেদিন আয়াত ভাইয়া তোরে কোলে নিয়েছিলো বলে তার গালে কি থাপ্পড়টাই না দিছিলি। আমি তার জায়গায় থাকলে তো তোরে লাথ্থি দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিতাম।সেদিকে তো উনি কিছুই করে নাই।''
''আয়াত''নামটা শুনতেই মাইশার বুকে যেন ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেলো। নীরব হয়ে গিয়েছে একপ্রকার। আনানকে কি বলবে এই চারদিন আয়াত নামক চরিত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিলো? যেই ছেলেটাকে যাচ্ছে না তাই বলেছে, যেই ছেলেটার সাথে শুভদৃষ্টিই হয়েছিলো একটা ভয়ঙ্কর ঝগড়া দিয়ে.............সেই ছেলেটার কথাই যেন মাইশার মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে।
--''কিরে ? চুপ হয়ে গেলি কেন?''
মাইশার হুঁশ ফেরার সাথে সাথেই আচমকা বলে ফেললো,
--''আয়াত ভাইয়ের কন্ট্যাক্ট নাম্বার তোর কাছে আছে?''
বলেই জিভ কাটে মাইশা। ইসসস ! আনান যদি বুঝে ফেলে তবে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ওপাশে আনান হতভম্ব। হুট করে মাইশার কথার আগাগোড়া যেন কিছুই বুঝতে পারলো না।
--''আমায় কি উনি নিজের কন্ট্যাক্ট নম্বর দিবে?এসব কি আবোল-তাবোল বলছিস তুই? ওইরকম সেলিব্রেটি মানুষের দেখা ক্ষণিকের জন্যই হয়েছিলো। আল্লাহই জানে আর কখনও দেখা হবে কি-না। কিন্ত তুই হঠাৎ উনার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছিস কেন?''
--''এ-এ-এমনিতেই। আচ্ছা রাখ। পরে কথা বলবোনে। আগানীকাল ক্যাম্পাসে দেখা হবে। গুড নাইট।''
আনানকে আর একটা কথা বলার সুযোগ না দিয়ে টুট করে কল কেটে মোবাইলটা খাটে ছুড়ে মারে। চিন্তায় পড়ে গিয়েছে যে আনান কিছু বুঝলো কি-না। চিলেকোঠার অগোছালো রুমটি থেকে বের হয়ে ছাদে পা রাখলো মাইশা। উত্তুরে হাওয়াতে সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছে ঠান্ডার আমেজ। দুতল বিশিষ্ট এই বাড়িটির ছাদ মাইশার খুবই প্রিয়। দক্ষিণ দিকের পাতাবাহারের ঝোপটা অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। ছাদের রেলিং ঘেষে বসে মাইশা খোলা আকাশটার দিকে তাকালো।
আকাশটা সুবিশাল। অল্প ব্যবধান নিয়ে তারাগুলো যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মাইশার হঠাৎই মনে পড়লো ট্রেনে সেদিনের রাতের কথা। আয়াতের নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় তাকানো, কালচে বাদামী চোখজোড়া ,ঠোঁটের স্মিত হাসি , ভয়ঙ্কর রেগে গেলে ফর্সা মুখমন্ডল অবলীলায় লাল হয়ে যাওয়া সবমিলিয়ে ছেলেটা অনন্য। কিন্ত ছেলেটার সৌন্দর্যের মায়ায় মাইশা পড়েনি , মাইশা হারিয়ে গিয়েছে ওর কথার মায়ায়। বিপদজনক নেশা আছে আয়াতের প্রতিটা কথায়, প্রতিটা ছন্দে।
সেদিন গাড়িতে যখন দুজনের চোখাচোখি হলো তখন তো মাইশার হার্টবিট যেন মিস হয়ে গিয়েছিলো। আচ্ছা, ওর কথা এত ভাবছে কেন মাইশা? এর উত্তর যেন পেয়েও স্বীকার করলো না। তাই বিড়বিড়িয়ে বললো,
--''আয়াত মানুষটা ভুলে যাবো আমি। ছেলেটা জাস্ট মোহ আর কিছুই না। রিলেক্স !''
--''যদি আমি তোমার মোহ না হই?''
কারও পুরুষালি কন্ঠে ঘোর ভাঙলো মাইশার। চট করে চোখ খুলে পাশে যা দেখলো তাতে অবাক না হয়ে পারলো না। আয়াত ওর পাশে রেলিংয়ে মাথা এলিয়ে বসে আছে। কালচে বাদামী চোখের সেই তুখর দৃষ্টি মাইশার দিকে। ভাবনার রাজকুমারকে কেউ যখন হঠাৎ সামনাসামনি দেখে ফেলে তখন কোনো প্রতিক্রিয়া করা যায় না। মাইশার এখন ঠিক ওমন অবস্থা। চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছে আর ঠোঁট রীতিমতো কাপঁছে। আয়াতের সেই স্মিত হাসি।
--''আ-আ-আপনি? এ-এখানে ক-ক-কিভাবে?''
--''হার্ট কানেকশন বেব ! তুমি চারদিন আমায় নিয়ে ভাবনার রাজত্ব করছো তাই রাজকুমারকে আসতে হবে না নিজের জংলী বিড়াল উপসস, ভাবুক রাণীর কাছে?''
আয়াতের এই কথাটা মাইশার নিঃশ্বাস বন্ধ করতে যথেষ্ট। ছেলেটার প্রতিটা বাক্য বুকে জোয়ার নিয়ে আছে। ইসসস ! এত মোহনীয়তা কেন এই কন্ঠের মধ্যে?
চারিদিকের ফুরফুরে হাওয়াতে আয়াতের উপস্থিতিটা মাইশার স্নায়ু নাড়িয়ে দিয়েছে। কেমন যেন দমবদ্ধকর অনুভূতি। ইচ্ছে করছে এই আগ্রাসী কন্ঠের ব্যক্তির প্রশস্ত বুকে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে। আয়াত একহাত দিয়ে আলতো করে মাইশার চুল কানে গুঁজে দিলো। কেঁপে উঠে মাইশা। মনে মনে দোয়া করছে এটা যেন কল্পনা হয়। এত মোহনীয় ব্যক্তির মায়াজালে কিছুতেই আবদ্ধ হওয়া যাবে না। আয়াত মিহি কন্ঠে বললো,
--''জীবন বারবার সবাইকে অপ্রত্যাশিত জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিবে। আমার প্রতি তোমার অনুভূতিটাও এমন। যতই আমার সাথে পায়ে পাড়া লেগে ঝগড়া করোনা কেন ! আমাদের হার্ট কানেকশন হয়ে গিয়েছে।''
--''হ-হার্ট ক-কানেকশন ?''
আয়াত ঠোঁট টিপে মৃদু হাসে। তারপর মাইশার কানের কাছে এগিয়ে বলে,
--''ইয়াহ্ মাইশুপাখি ! আমার প্রেমে পড়েছো তুমি। নাহলে এভাবে দিনরাত আমার জল্পনা কল্পনা করে বেড়াতে না। ভাবতে না আমার কথা। সেদিনের পর নিমিষেই আমায় ভুলে যেতে।''
মাইশা এখন ঘোরের মধ্যে আছে । এটা কি আদৌ আয়াত নাকি ওর অবচেতন মন এটা বুঝতে পারছে না। কাপাকাপা গলায় বললো,
--''আমি কেন আপনার প্রেমে পড়বো?Why I'm in love with you?''
মাইশার জোরালো কন্ঠ। আয়াত মাইশার কানের লতিতে আলতো করে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে বললো,
--''কারন তোমার পাগলামিটা আমার ভালোলাগে। আর এটার জন্যই তুমি আমার প্রেমে পড়েছ ;I like your madness মাইশুপাখি !''
.
.
হুড়মুড়িয়ে মাইশা চোখ খুললো। নিজেকে খোলা ছাদে আবিষ্কার করে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে। আশেপাশে তাকিয়ে আয়াতকে না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মাইশা। অনবরত নিঃশ্বাস ফেলছে। কপালে আর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম।এতক্ষণ সেই অপ্রত্যাশিত স্বপ্ন দেখে মাইশার অবচেতন হাত আচমকাই ডান কানের লতি স্পর্শ করলো। এখানেই আয়াতের ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করেছে স্বপ্নে। এরকম একটা স্বপ্ন মাইশা যে কখনও দেখবে মাইশা তা ভাবতেও পারেনি। কানের মধ্যে এখনও বেজে চলছে,
--''''কারন তোমার পাগলামিটা আমার ভালোলাগে। আর এটার জন্যই তুমি আমার প্রেমে পড়েছ ;I like your madness মাইশুপাখি !''
মাইশা বিড়বিড়িয়ে বললো,
--''এই madness madness এর চক্করে আমি সত্যি সত্যি mental hospital এ চলে যাবো।''
-------------------------------------------------
দুপুরের কড়া উত্তাপে খাঁ খাঁ করছে সবকিছু। ক্যাম্পাসে বহু শিক্ষার্থীর আনাগোনা। অদূরেই ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্টদের রাগিং হচ্ছে। আবার কোথাও ফ্েন্ডরা মিলে আড্ডাবাজি দিচ্ছে।কিন্ত আজ মাইশাদের পরিবেশটা ভিন্ন। সামাদ আর পৃথার সামনে বিয়ে উপলক্ষে ছোটখাটো সেলিব্রেশন করছে ক্যাম্পাসে।দুটো কেকের মধ্যে একটার আবার যাচ্ছেতাই অবস্থা।সবাই এখন ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে পার্কিং সাইটে। ওদিকে রাগিং দেখে পৃথা এবার বললো,
--''আমরা যে কবে এদের ragging করবো? শালা মাস্টার্সের পোলাপাইনগুলাই ভার্সিটিতে রাজত্ব করে। আমাদের কোনো অধিকার নাই?''
--কিসের অধিকার? [সামাদ]
--''কিসের আবার, ragging এর।''
--''ragging কোনো ভালো মানুষরা করে না। [সামাদ]
--''এই গাজাখুরি কথা কে কইসে তোরে? ragging করলে ভালো ভালো ragging করমু। মনে আছে সামাদ, আমাদের প্রথম দিন কি করতে বলছিলো?''[আনান]
--''সেটা কি আর না ভোলার মতো?''
মাইশা এতক্ষণ উদাসীন ভঙ্গিতে সামাদের বাইকে বসে ছিলো। আনানের কথা শুনে মাইশা আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
--কি করেছিলো?
--আমাদের আন্ডারপ্যান্ট খোলাইয়া জিন্স প্যান্টের ওপর পরতে কইছে।ব্লু জিন্সের ওপর লাল টুকটুকা আন্ডারপ্যান্ট , কি যে বিচ্ছিরি লাগছিলো।''
হো হো করে হেসে ওঠে সবাই। আনানের মুখ ফাটা বেলুনের মতো চুপসে আছে। অর্পি কোনোরকম হাসি থামিয়ে বললো,
--''ইসসস ! আমার তো কল্পনা করতেই হাসি আসছে। তোরে তো পুরাই সুপারম্যান লাগছিলো । তাই না রে?''
--''জাইঙ্গা ম্যান লাগছে আমারে।থাক। তোর আর কল্পনা করতে হইবো না।''
আনানের কল্পনা শব্দটা শুনতেই মাইশার হাসিটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। গতরাতে আয়াতকে নিয়ে একটা ভয়ঙ্কর কল্পনা করেছিলো ও। সেটা ভাবতেই মাইশা যেন লজ্জা পেয়ে যাচ্ছে। অর্পি এবার বললো,
--''তোর আবার কি হলো মাইশু?''
--না..........না। তেমন কিছুনা। অনেকক্ষণ তো হলো আড্ডা দিচ্ছি। আমি এবার বাসায় যাবো। এমনিতেও বাসায় কিছু কাজ আছে। ''
--''তার আগে আমার তোর জন্য একটা গিফট আছে।''
আনানের আগ্রাসী কন্ঠ। মাইশা অবাক গলায় বললো,
--''কি গিফট?''
আনান এবার বার্থডে স্প্রে নিয়ে মাইশার মুখ মাখামাখি করে দিলো। আনান দাঁত কেলিয়ে বললো,
--''নে তোর গিফট ! পুরাই পেত্নী লাগছে।''
সাদা ফেনার প্রভাবে ঠিকমতো তাকাতে পারছে না মাইশা। তবুও চেচিয়ে বললো,
--''হারামি কোথাকার? আজ তোর একদিন আর আমার চৌদ্দ দিন।''
এই বলে চকলেটের আস্ত কেকটা নিয়ে আনানের দিকে এগিয়ে গেলো। উদ্দেশ্য , শয়তানটার মুখে মারবে। আনানের ভৌ দৌড় এর সাথে সাথেই মাইশাও পিছে ছুট দিলো। চিল্লিয়ে বললো,
--''আনান থাম। আজ তোর ধলা মুখটারে যদি কাইল্লা না করছি আমার নামও মাইশা না। ''
সারা পার্কিং সাইট গমগম করছে এ পরিস্থিতিতে। মাইশা কেকটা আনানের দিকে ছুড়ে মারতেই দুর্ভাগ্যবশত তা আনানের মুখে না লেগে লাগলো অন্য কারও মুখে। থেমে গেলো মাইশা। সাথে হৈ হুল্লোড় টাও। মাইশা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আগন্তুকের পাশে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। শাওন দাঁড়িয়ে আছে।তবে যেই ছেলেটার মুখে মাইশা কেক ছুড়ে মারলো সেটা কি তবে..............
মাইশা কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,
--''আপনি?!''
No comments